ইনসেপশন মানে হলো কারো অজ্ঞাতে তার মনে কোন একটা আইডিয়া পুতে দেয়া। কবের মতে যার মনে আইডিয়া পুততে হবে সে যদি গভীর ঘুমে থাকে তবে তার মনে পুতে দেয়া চিন্তাকে নিজের মনে করবে। আধুনিক দর্শন যার হাতে জন্ম হয়েছে বলা হয়, সেই দার্শনিক রেনে দেকার্টের ‘মেডিটেশন অন ফার্স্ট ফিলোসফি’ প্রকাশ হয়েছিল ১৬৮৫ সনে। সে তুলনায় ইনসেপশন নামক মুভির জন্ম এই তো সেদিন। এই ছবির মূলভিত্তি হল স্বপ্ন শেয়ারিং এবং স্বপ্ন তৈরি করা। অর্থাৎ অন্যের অবচেতন মনে ঢুকে স্বপ্ন অবজার্ভেশন করা এবং নিজেদের উদ্দেশ্যকে সফল করার জন্য স্বপ্নের পরিবেশ তৈরি করা। এই কাজে তারা উপস্থিতবুদ্ধি সম্পূর্ণ একজন অর্কিটেকের সহয়তা নেয়।
এখন কথা হচ্ছে কিভাবে তারা একই সাথে তিন চার জন একই স্বপ্নে প্রবেশ করে? মূলত এই স্বপ্নে প্রবেশে তারা ছোট একটা প্রক্রিয়া অবলম্বন করে যেটা হল পুরা সাইন্সফিকশন অর্থাৎ এটার বাস্তব কোন লজিক নেই। বাস্তবধর্মী মেডিটেশন কিংবা হিপনোটাইজ প্রক্রিয়ায় যেভাবে মানুষের মনকে নিয়ন্ত্রণ করা হয় এখানে সেইরূপ কোন সাইন্টিফিক কোন মেথড ব্যবহার করা হয় না। বরং একটা ছোট ডিভাইস ব্যবহারের মাধ্যমে কাজটি করা হয়। তাই মুভির আসল স্বাদ অনুভব করতে হলে আপনাকে এটা মেনে নিতে হবে। আপনি অতিরিক্ত বাস্তববাদী হলে এই মুভি না দেখাই ভালো। আর অবশ্যই মুভিটি সাবটাইটেল ছাড়া দেখবেন।

মুভিটা শুরু হয় সমুদ্র সৈকতে অচেতন অবস্থায় একজনকে (কোব=ডিক্যাপিও) পাওয়ার মধ্য দিয়ে। কোবকে নেয়া হয় মিঃ সাইতো এর সামনে। এরপর শুরু হয় কোব ও সাইতোর মুখোমুখি হবার পূর্ববতী ঘটনা। কোব মুলত একজন এক্সট্রাক্টর। এক্সট্রাকর হল সেই যে অন্যের স্বপ্নে প্রবেশ করার ক্ষমতা রাখে সাথে সাথে সে স্বপ্নকে নিয়ন্ত্রণও করতে পারে। প্রয়োজনে সে অন্যের হাত থেকে স্বপ্নর মাধ্যমে যাতে কেউ তার আইডিয়াকে চুরি করতে না পারে সেই ব্যবস্থাও করতে পারে।
অপরদিকে মিঃ সাইতো একজন ক্ষমতাধর ব্যবসায়ী। কোবাল ইঞ্জিনিয়ারিং নামক এক কোম্পানি কোব ও তার সহযোগীদেরকে ভাড়া করে স্বপ্নের মাধ্যমে মিঃ সাইতোর এক গোপন নথির তথ্য উদ্ধার করতে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় তারা সেটা করতে ব্যর্থ হয়। মিঃ সাইতোর নিকট স্বপ্নের মাধ্যমে অন্যের গোপন নথি সম্পর্কে জানার এই প্রক্রিয়া মৌলিক আইডিয়া এবং বেশ কার্যকরী মনে হয় ফলে সে কোব ও তার সহযোগী মিঃ আর্থার ( জোসেফ) কে তার হয়ে একটি কাজ করার অনুরোধ করে। তবে সেটা তথ্য জানা নয় বরং তার ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বীর মনে এমন এক ধারনা ঢুকিয়ে দেয়া যাতে সে নিজ থেকেই নিজের ব্যবসাকে ধ্বংস করে দেয়। এই আইডিয়া ঢুকিয়ে দেয়াকেই “ইনসেপশন” বা “সূচনা” বলে।

মজার বিষয় হচ্ছে কোব ও আর্থার আগে কখন এমন কাজ করে নি। এবং তারা জানে এই কাজটি করতে হলে স্বপ্নের তৃতীয় লেয়ারে যেতে হয়। যেটা শুধু কষ্টসাধ্য নয় বরং জীবনের জন্যও হুমকির সামিল। সেইজন্য তারা প্রথমে রাজি হয়নি কিন্তু যখন মিঃ সাইতো কাজটির বিনিময়ে কোবকে তার সন্তানদের কাছে অর্থাৎ বাড়িতে ফিরতে সাহায্য করবে বলে তখন কোব রাজি হয়। কারণ কোব তার স্ত্রী ম্যালের হত্যা মামলার আসামী। সেই কারনে সে অনেক বছর ধরে দেশে ফিরতে পারছে না। এইটুকুই কাহিনী।
এখন ডিক্যাপিও (কোব) কি কাজটি ঠিকভাবে করতে পেরেছে কিনা নাকি কাজটি করা আদৌ সম্ভব না? সে কি তার বাচ্চাদের কাছে ফিরে যেতে প্রেছে? এটা জানতে হলে আপনাকে মুভিটা অবশ্যই দেখতে হবে। এই ছবির সবচেয়ে সুন্দর দিক হল, এখানে আমরা সচারচর স্বপ্নের মধ্যে যে দৃশ্য গুলো দেখি পরিচালক ক্রিস্টোফার নোলান চেষ্টা করেছে ঠিক সেইরূপ দৃশ্য তুলে ধরতে। আমার মতে পরিচালক অনেকাংশ সার্থক।

কিন্তু স্বপ্নের লেভেলগুলো বুঝতে আপনাকে অবশ্যই মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হবে। ১ম লেভেল হচ্ছে সচারচর ঘুমালে আমরা যে স্বপ্ন দেখি। ২য় লেভেল হল, আপনি যদি স্বপ্নের ভেতর আবার স্বপ্ন দেখেন। ৩য় লেভেল হল ২য় স্বপ্নের ভেতর যদি আবার স্বপ্ন দেখেন। । এখন আপনার স্বপ্ন ভেঙ্গে যাওয়া মানে এই না আপনি বাস্তবে ফিরে আসলেন। বরং আপনি স্বপ্নের ২য় লেভেলে আছেন। আবার স্বপ্ন ভাঙ্গলে আপনি আসবেন ১ম লেভেলে। এরপর যদি স্বপ্ন ভাঙ্গে তবেই আপনি বাস্তবে ফিরে আসবেন। এই সিকুয়েন্স মেনটেইন করেই মুভির কাহিনী এগিয়ে চলে। আপনার প্রথম কাজ হচ্ছে এই সিকুয়েন্স টা ধরে রাখা। তাহলেই মুভির কাহিনী বুঝা সহজ হবে।
ফিল্মি রিভিউ সম্পর্কে অন্যান্য লেখা –
- অজ্ঞাতনামা – মুভি রিভিউ
- ডিপারচারস – মুভি রিভিউ
- V for Vendetta: মুভি রিভিউ
- মাই নেইম ইজ খান – মুভি রিভিউ
- কে জি এফ – চ্যাপ্টার ২: মুভি রিভিউ
আরেকটা জিনিস খেয়াল রাখতে হবে সেটা হল “সময়”। স্বপ্নে সময়ের গতি বাস্তব জগতের চেয়ে বেশি। ফলে বাস্তব জগতের ৫ মিনিট স্বপ্নে সেটা মনে হবে ১ ঘন্টার মতো। শুধু তাই নয় স্বপ্নের লেভেল যত বাড়বে এই গতি তত বৃদ্ধি পাবে। তাই ছবি দেখার মুহুর্তে এই সময়ের গতি বেগের দিকেও ভালো করে খেয়াল রাখতে হবে। এই গতিবেগের মূল রহস্য হল, আমাদের অবচেতন মনের চেতন মনের চেয়ে দ্রুত কাজ করার ক্ষমতা। আরেকটা বিষয় ছবিটাতে ব্যবহার করা হয় সেটা হল টোটেম। টোটেম হল একপ্রকার ছোট লাটিম। যার মাধ্যমে তারা বুঝতে পারে সে কি স্বপ্নে নাকি বাস্তবে আছে। নাকি তাঁর স্বপ্নে অন্য কেউ স্বপ্ন ঢুকিয়ে দিয়েছে। লাটিম ঘুরতে

মুভিটির মাধ্যমে ক্রিস্টোফার নোলান মুলত আমাদের চিন্তার ও গবেষণার জন্য নতুন একটি ক্ষেত্রের সন্ধান দিয়েছেন। কোনভাবে যদি সত্যি সত্যি স্বপ্ন শেয়ারিং ও স্বপ্ন তৈরি ব্যপারটা নিয়ন্ত্রন করা যায়। অর্থাৎ অবচেতন মনকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তবে সত্যিই একটা শিল্প বিপ্লবের মতো একটা বিপ্লব ঘটে যাবে। ব্যপারটা বুঝার আগে আপনাকে আগে বুঝতে হবে অবচেতন মন কি? এবং অবচেতন মনের ক্ষমতা কতটুকু?
ধরুন আপনার সামনে একপ্লেট সুস্বাদু খাবার রাখা আছে। কখনও কি এমন হয়েছে, আপনি মনের ভূলে বামহাত দিয়ে খাবার খাচ্ছেন। আপনার এই দীর্ঘ জীবনে এমনটা কখনও হয়নি এবং কাজগুলোও আপনি চিন্তা ভাবনা করেও করেননি। বরং আপনার চেতন মনের অলক্ষ্যেই হয়ে গেছে বা হচ্ছে। আপনি ভালো করে খেয়াল দেখবেন, হঠাৎ করে উড়ে আসা কোন ঢিল প্রতিরোধে আপনার শরীর অটোমেটিক সঠিকভাবে মুভ করছে আপনার বিনা ইন্সট্রাকশনে। এই কর্মকান্ড আপনার চেতন মনের নিয়ন্ত্রনে না। এইগুলো ঘটে অবচেতন মনে। শুধু তাই নয় এইকাজগুলো অবচেতন মনের গভীরের এমনভাবে প্রথিত আছে যা আপনার পক্ষে কখনও তা থেকে সরে আসা সম্ভব না।

আর আমরা জানি স্বপ্নে আমাদের অবচেতন মন উম্মুক্ত হয় আর চেতন মন বন্ধ থাকে। তাই পরিচালক ক্রিস্টোফার নোলান চেষ্টা করেছে স্বপ্নের মাধ্যমে অবচেতন মনের কর্মকান্ডকে নিয়ন্ত্রন করার। এবং তার মাধ্যমে অবচেতন মনের গভীরে কিছু আইডিয়া প্রথিত করা। যাতে সেটা বাস্তব জীবনেও ঢিল প্রতিরোধের মতো কোন কাজে লাগে।
কি ভাবছেন? অন্যের মাথায় এইভাবে আইডিয়া ঢুকানো কি আদো সম্ভব? হ্যাঁ সম্ভব। এই যে আমি যেভাবে আপনাদের চেতন মনে আইডিয়া ঢুকিয়ে দিয়েছি এই বলে যে, এই ছবিটা সাবটাইটেল ছাড়া দেখবেন না। আপনার চেতন মন অলরেডি ঠিক করেই নিয়েছে যে, inception ছবিটা সাবটাইটেল ছাড়া দেখা যাবে না? ঠিক একই ভাবে অবচেতন মনেও আইডিয়া প্রথিত করা যাবে।
ডিক্যাপিও, ট্রম হার্ডি, ক্যান, আর্কিটেক চরিত্রে ইলেন পেইজ, জোসেফ গর্ডন সবাই ভালো অভিনয় করেছে। আমি মনে করি সবচেয়ে বড় অভিনেতা হল পরিচালক ও লেখক ক্রিস্টোফার নোলান। এমন একটা থিম নিয়ে ছবি করার ভাবনা এবং সেটা সার্থক ভাবে উপস্থাপন করা চাট্টিখানি কথা না।

সবশেষে, ক্রিস্টোফার নোলান তার এন্ডিং টা রেখেছিলেনই এমনভাবে, যাতে সবাই এ নিয়ে প্রশ্ন করতে থাকে। অর্থাৎ পয়েন্ট ড্রিম বা রিয়েলিটি নয়, পয়েন্ট কব তার সন্তানদ্বয়ের নিকট পৌঁছে গিয়েছেন। সেটা বাস্তব হোক আর মিথ্যা। তবে যুক্তিখণ্ডন করতে গেলে খুব সহজেই বলা যায়, তিনি রিয়েলিটিতে তার সন্তানদের নিকট ফিরে গিয়েছিলেন। কেননা স্বপ্নের মধ্যে তার সন্তানদের চেহারা দেখানো হয় না, যার কারণে ঠিক যখনই তাদের সন্তানদের চেহারা দেখানো হয়, তখনই বোঝা যায় তিনি অবশেষে রিয়েলিটিতে গিয়েছেন।
২:২০:৫২ তে টোটেমটি ঘুরতে থাকলেও ২:২০:৫৪ তে টোটেমটি একদিকে হেলে পড়ে আর ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকে টোটেম পড়ে যাওয়ার একটা শব্দ শোনা যায়। অর্থাৎ ক্লিয়ারলি বোঝা যায় কব রিয়েলিটিতে ফিরে গিয়েছিলেন!
২৭/০১/২০২২, ০২.৩৫ PM

